পর্ব – ৫/৫ :
আর্যরা মূলত কোথাও থেকে আসেনি। বিগত প্রায় ৬০০০০ বছর ধরে তাঁরা ভারতীয় উপমহাদেশেই বসবাস করছিল এবং ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তারা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতা তৈরি করেছিল, সেটা হলো সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা।
হরপ্পা সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ বিগত কয়েক বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন কার্যের ফলে পাওয়া গেছে। প্রতিটা শহরের ডিজাইন, প্ল্যানিং, লে আউট সব এক। এক রকম নিকাশী ব্যবস্থা, খাদ্যশস্য ভাণ্ডার, স্নানাগার, বড় বড় প্রাসাদ, সব শহরেই পাওয়া গেছে। খ্রীঃ পূঃ ২৬০০ সালে মেসোপটেমিয়ার সাথে হরপ্পার বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হরপ্পার সীলমোহর, গয়নার যে রকম নমুনা পাওয়া গেছে, একে তাই কোনো বিচ্ছিন্ন সভ্যতা না বলে এক সুশাসিত সাম্রাজ্য বলা উচিত হবে।
হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংস প্রধানত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হয়েছিল। মহেঞ্জোদারো শহরেই ৩ বার ভীষণ বন্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও মহেঞ্জোদারো অনেক উঁচুতে অবস্থিত ছিল। কিন্তু নীচু জায়গা সব সম্পূর্ণ রূপে জলের তলায় জলে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল, আর সেই সব জায়গার খোঁজ এখন পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই পালিয়ে যাওয়া ছাড়া নাগরিকদের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। গুজরাটের লোথাল একটা বড় বন্দর শহর ছিল। জল দিয়ে ঘিরে যেখানে নোঙ্গর ফেলা হতো, আজো একি রকম আছে। বড়সড় কোনো আক্রমণ হলে সব ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো। এখনো পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতার কোনো জায়গায় আক্রমণের কোনো চিহ্ন নেই। কাজেই বন্যা ছাড়া ধ্বংসের অন্য কারণ ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না।
সরস্বতী নদী খুব বিশাল ছিল যা শুকিয়ে যায়। সিন্ধু নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এদের প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। এই সব জায়গার মাটি লবণাক্ত হয়ে যায়। রাজস্থান মরুভূমিতে পরিণত হয়। সরস্বতী নদী শুকিয়ে যাবার পর মানুষ পূর্বে সরে আসে গঙ্গা যমুনা অববাহিকায়। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় এই সময় পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে আসার। খ্রীঃ পূঃ ১৯০০ এর পরে মেসোপটেমিয়ার সাথে আর কোনো বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় যে শাসন ছিল তা দুর্বল হয়ে যায়। অর্থনীতিও ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ বেকার হয়ে যায়। পরবর্তী কালের হরপ্পা শহরে আগের মত নগর পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়নি। বড় বড় বাড়ির বদলে ছোট ছোট বাড়ি পাওয়া যায়। শিল্পের অবনতি, নিকাশী ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রশাসন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। বড় শহর বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেলো। ছোট শহরে মানুষের ভিড় বেড়ে গেলো। কাজের অভাব, খাদ্যের অভাব হলো কারণ জমি সব অনুর্বর হয়ে যায় বন্যার জন্য। কাজেই মানুষ উর্বর জমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো।
১৯৯৫-১৯৯৮ সালে মেহেরগড়, নৌশারো এবং পিরাকে ব্যাপক খননকার্য চলে। এই জায়গাগুলো প্রমাণ করে যে উন্নত শহুরে হরপ্পা সভ্যতা থেকে কিভাবে গ্রাম্য সভ্যতায় পরিণত হলো।
নাগরিক মানুষ অবস্থার বিপাকে পড়ে গ্রামীণ হয়ে গেলেও সংস্কৃতি কিন্তু নষ্ট হয়ে যায় না। রীতিনীতি হারিয়ে যায় না। ধীরে ধীরে শুধু বিবর্তন হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতার ওজন ও পরিমাপের পদ্ধতি গুপ্ত যুগেও পাওয়া যায়। বর্তমানে আমরা যে জগ, গরু বা পশু টানা গাড়ির অংশ, চিরুনি ব্যবহার করি, সেগুলো হরপ্পা সভ্যতার সময়েও ব্যবহৃত হতো।
১৭৯০ সালে জন প্লেফেয়ার একটি হিসাব কষে বলেন যে হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানের শুরু খ্রীঃ পূঃ ৪৩০০ তে। বৈজ্ঞানিক ভাবে এই তথ্যের বিরোধিতা কেউ করেনি। কিন্তু বেন্টলে যে অযৌক্তিক অবাস্তব কারণ দেখান, সেটা সম্পূর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামি। যেহেতু খ্রীঃ পূঃ ৪০০০ এর আগের সময় বাইবেলের সময়পঞ্জী বহির্ভূত, তাই ব্যাখ্যা হলো না।
মূলত ঋক বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে কোনো বহিরাগত আক্রমণকারী আসেনি। বরঞ্চ বলা যায় যে দেশীয় সভ্যতার মৌলিক পুনর্গঠন হয়েছিল মাত্র।
ইউরোপীয় পণ্ডিতরা যে ঋক বেদের রচনাকাল খ্রীঃ পূঃ ১৫০০ ধরেছিলেন, সেটাও কিন্তু গোড়াতেই ভুল হয়েছে। কারণ বেদ ‘শ্রুতি অর্থাৎ বহু বছর ধরে প্রচলিত এই বেদ যা মানুষ শুনে মনে রেখে এসেছে। সেক্ষেত্রে কথ্য ভাষার পরিবর্তন হলেও শ্রুতি কিন্তু অপরিবর্তিত থাকার সম্ভাবনা বেশী। অনেকে হরপ্পা সভ্যতার সাথে যজুর্বেদের মিল খুঁজে পেয়েছেন। আর ঋক বেদ হয়তো তার আগের সভ্যতায় তৈরি হয়েছিল, যখন সরস্বতী নদী প্রধান নদী ছিল।
আর ঠিক এখানেই শুরু হলো সব সমস্যার সূত্রপাত। কারণ ঋক বেদ ও অন্যান্য বৈদিক সাহিত্য পড়লে বোঝা যায় যে ভারতীয় সভ্যতা কতটা প্রাচীন। ভারতীয় সভ্যতা আসলে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা। ইউরোপীয় সভ্যতা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ভারতীয় সভ্যতার কাছে নিতান্তই শিশু হয়ে গেলো। কাজেই শুরু হলো কাটাছেঁড়া। অবৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়ে গেলো বৈদিক সভ্যতা ইউরোপীয় সভ্যতার অবদান। ভারতীয় ভাষা ইউরোপীয় ভাষা থেকে সৃষ্ট। ভারতীয় বিজ্ঞান, দর্শন গ্রীসের বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আমরা সনাতনীরা এই তত্ত্ব আজো বিশ্বাস করি। আজো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস পড়ানো হয়, তাদের অনুবাদ করা ধর্মগ্রন্থ পড়ানো হয়।
আমরা আজো আমাদের ইতিহাসে ইউরোপের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন করিনি। দয়ানন্দ সরস্বতী, ঋষি অরবিন্দ বা বাল গঙ্গাধর তিলকের মত হাতে গোনা কয়েক জন ছাড়া সেই সময় এর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। আজো মনে করা হয় যে আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী এবং তারা ইউরোপীয় বংশধর …
❝ আর্যরা কি বহিরাগত ছিলো? ❞ শিরোনামের লেখাটি সংগৃহীত ছিলো তবে পাঠ সুবিধার্থে পরিবর্তন সাধন করে উক্ত শিরোনাম দিয়ে লেখাটিকে ৫ খন্ডে বিভক্ত করে প্রকাশ করা হলো।
সম্পূর্ণ সিরিজটির তথ্যসূত্র :
• T. Kivisild et. al, Current Biology, Vol 9, No 22, pp 133-134
• Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, by Jonathan Mark Kenoyer, Oxford University Press, Karachi/American Institute of Pakistan Studies, 1998.
• Myth of the Aryan Invasion of India by David Frawley
• Koenaard Elst
• Indian Gods and Kings, The Story Of A Living Past by Emma Hawkridge, Houghton Miffin Company 1935
• Concise History of the World, An Illustrated Time Line by National Geographic
• Racial Elements in the Population by Dr B S Guha
