আর্যরা বহিরাগত : একটি পরিকল্পিত ইউরোপীয় তত্ত্ব
পর্ব – ২/৫ :
আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী এই তত্ত্ব মূলত Abbe Dubois এবং Max Muller এর লেখায় বহুল প্রচলিত হয়। Abbe Dubois এর লেখা ফ্রেঞ্চ বই এর ইংরেজি অনুবাদ Hindu Manners Customs And Ceremonies
(1897) এই বইতে তিনি আরব ও মিশরের মানুষদের ভারতে আসার পরিবর্তে ককেসিয় অঞ্চলের মানুষদের অখন্ড ভারতবর্ষে আগমনের সপক্ষে বলেন।
ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্লোরেন্সের এক ব্যবসায়ী Filippo Susseti প্রথম সংস্কৃত ও ইউরোপীয় প্রধান ভাষার সাথে মিল খুঁজে পান। পরে ১৭৮৬ সালে বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটিতে স্যার উইলিয়াম জোন্স এই তত্ত্বকে সমর্থন করেন। পরবর্তী কালে ভাষাতত্ত্ববিদ ম্যাক্স মুলার এই তত্ত্বকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তার Lecture On The Science Of Languages এ এই তত্ত্বকে আরো প্রামাণ্য করে তোলেন এই বলে যে সংস্কৃত, পারসি, গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান, গথিক ও সেলটিক এই সাতটি ভাষাকে ইন্ডো আর্য ভাষা বলা হয় এদের মধ্যে ভাষাগত মিলের জন্য।
এদের ‘প্রোটো ইন্ডো ইউরোপীয়’ ভাষা গোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করা হয় যার মধ্যে মাত্র দুটো ভাষা ইউরোপের বাইরের ভাষা। কাজেই ম্যাক্স মুলার এই সিদ্ধান্তে আসেন যে যেহেতু এরা একটিই প্রাচীন ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত
কাজেই তাদের পূর্ব পুরুষ সবাই এক জায়গায় বসবাস করতো। এদের আদি বাসস্থান ইউরোপ ছিল। আর মাত্র দুটো এশীয় ভাষা বলে ধরে নেওয়া হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে আর্যদের খুব উন্নত বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ১৯২০ সালে হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা আবিষ্কারের পর। কারণ পুরাতাত্ত্বিক ভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় যে হরপ্পা সভ্যতা অত্যন্ত উন্নত ছিল। তখন এই তত্ত্বকে বদলে দেওয়া হয়, আর্যদের যাযাবর জনজাতি বলে উল্লেখ করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কারের পর নতুন আর এক ঘৃণ্য চক্রান্তের আরম্ভ।
বলা হলো বহিরাগত আর্যরা উন্নত অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নাগরিক কিন্তু অনুন্নত হরপ্পা সভ্যতাকে ধ্বংস করে। পরাজিত হরপ্পা সভ্যতার মানুষ তাদের আদি বাসভূমি ছেড়ে দক্ষিণে প্রস্থান করে এবং এই ভাবে কালক্রমে দ্রাবিড় জনজাতির উদ্ভব হয়। তাই এদের ভাষা গোষ্ঠী আলাদা, গায়ের রঙ আলাদা, সংস্কৃতি ভিন্ন। এদেরকেই আর্যরা নিম্ন বর্ণ শূদ্র বলে অভিহিত করে। এখানে এক সাথে ভারতে দুই আলাদা জনজাতির উদ্ভব করা হলো, জাতিভেদের উৎপত্তি দেখানো হলো।
এই ইতিহাস বিকৃত করার পিছনে এক পক্ষের অবদান বিরাট। বাইবেলের সময়পঞ্জী অনুসরণ করে এই তত্ত্ব তৈরি করা হয়। বাইবেল অনুযায়ী পৃথিবীতে সভ্যতার সূত্রপাত ৪০০০ খ্রী: পূ: সময়ে হয়। বন্যার সময় ২৫০০ খ্রী: পূ: বলে উল্লেখ করা আছে। তাই আর্যদের ভারতে আগমনের সময় ধরা হয় ১৫০০ খ্রী: পূ: নাগাদ।
কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। সবটাই নিজেদের কল্পনা বললে মন্দ হয় না।
এই তত্ত্বের উদ্ভাবনের পিছনে আসল কারণ নিয়ে পরবর্তী অংশে আলোচনা করা যাবে।
